ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অতীত এবং বর্তমান অবস্থা।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অতীত এবং বর্তমান অবস্থা।
ফিলিস্তিনের ইতিহাস জটিল এবং বহুস্তরীয়।
এটি হাজার বছরের একটি অধ্যায় জুড়ে বিস্তৃত, যেখানে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংঘাতও অন্তর্ভুক্ত
রয়েছে। নিচে ফিলিস্তিনের অতীত এবং বর্তমান অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
অতীতের অবস্থা
1. প্রাচীন যুগ:
ফিলিস্তিন অঞ্চলটি প্রাচীন সভ্যতাগুলির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখানে কনানীয়, মিশরীয়,
ফিনিশীয় এবং ইজরায়েলীয় সভ্যতার প্রভাব পড়ে।
- বাইবেলের সময় এটি "কানান" নামে পরিচিত ছিল।
- খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে এখানে ইজরায়েল রাজ্য গঠিত হয়।
2. রোমান এবং বাইজেন্টাইন যুগ:
খ্রিস্টীয় ৭০ সালে রোমান সাম্রাজ্যের সময় ইহুদীদের বিপ্লব ব্যর্থ হলে অনেক
ইহুদীকে বিতাড়িত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে, বাইজেন্টাইন শাসন ফিলিস্তিনে খ্রিস্টানদের প্রভাব বৃদ্ধি করে।
3. ইসলামী যুগ (৬৩৬ সাল থেকে):
ইসলামী খিলাফতের অধীনে ফিলিস্তিন মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এটি
ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর জেরুজালেমের কারণে।
-৬৩৬ সালে রাশিদুন খিলাফতের সময় ফিলিস্তিন বিজিত হয়।
-উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময় ফিলিস্তিন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক
কেন্দ্র ছিল।
4. অটোমান শাসন (১৫১৭-১৯১৭):
প্রায় ৪০০ বছর ধরে ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই সময়ে অঞ্চলটি
তুলনামূলক স্থিতিশীল ছিল।
বর্তমান অবস্থা
1. ব্রিটিশ ম্যান্ডেট এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন (১৯৪৮):
-১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণায় ব্রিটিশরা ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি "জাতীয়
ঘর" প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানায়।
-১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেয়, যা আরবরা
প্রত্যাখ্যান করে।
-১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এতে
ফিলিস্তিনীরা তাদের ভূমি হারায়, যা "নাকবা" (বিপর্যয়) নামে পরিচিত।
2. পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার অবস্থা:
-পশ্চিম তীর (জর্ডানের অধীনে ছিল ১৯৬৭ পর্যন্ত) বর্তমানে ইসরায়েলের সামরিক
দখলে রয়েছে।
-গাজা উপত্যকা ২০০৭ সাল থেকে হামাসের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং এটি একটি অবরুদ্ধ
অঞ্চল।
3. শরণার্থী সমস্যা:
লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাদের অধিকাংশই লেবানন, জর্ডান, এবং সিরিয়ায় অবস্থান করছেন।
4. শান্তি প্রক্রিয়া এবং সংঘাত:
-ওসলো চুক্তি (১৯৯৩-১৯৯৫) ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে কিছুটা আশা জাগালেও
তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়।
-ইসরায়েলি বসতি স্থাপন এবং ভূমি দখলের ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে।
5. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:
-অধিকাংশ দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই প্রক্রিয়াকে জটিল করেছে।
ফিলিস্তিনের বর্তমান চ্যালেঞ্জ
-ভূমি দখল এবং বসতি স্থাপন: ইসরায়েলি বসতি স্থাপন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা
পশ্চিম তীরের অধিকাংশ ভূমিকে ফিলিস্তিনীদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
-মানবিক সংকট: গাজা উপত্যকায় অবরোধ, জলবায়ু সমস্যা, এবং দারিদ্র্য মানবিক
পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলছে।
-রাজনৈতিক বিভাজন: হামাস এবং ফাতাহর মধ্যে বিভেদ ফিলিস্তিনের ঐক্য ও স্বাধীনতা
আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সংঘাতের প্রধান কারণ
1. ভূমির মালিকানা:
ফিলিস্তিন অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান হলেও ইহুদি ও আরব উভয় সম্প্রদায় এই ভূখণ্ডকে তাদের ঐতিহ্যগত এবং ধর্মীয় অধিকারের অংশ হিসেবে দাবি করে।
2. ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা:
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি
"জাতীয় ঘর" প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানায়। এই সময়ে ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অধিবাসী
আরব ছিলেন।
3. ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৮):
-ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। ফিলিস্তিনি জনগণ
তাদের ভূমি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে পড়েন।
-এই ঘটনার ফলে "নাকবা" (বিপর্যয়) ঘটে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি
জাতীয় ট্র্যাজেডি।
4. ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ও দখল:
-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং
গোলান মালভূমি দখল করে।
-এই দখল ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে এবং তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
স্বপ্ন বাধাগ্রস্ত হয়।
5. বসতি স্থাপন:
ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী
এটি অবৈধ বলে গণ্য হলেও ইসরায়েল তা অব্যাহত রেখেছে।
মুখ্য সংঘাতের বিষয়গুলো
1. পূর্ব জেরুজালেম:
ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি
করে, কিন্তু ইসরায়েল এটি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
2. শরণার্থী সমস্যা:
১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর লাখো ফিলিস্তিনি শরণার্থী হন। তাদের ফিরে আসার অধিকার
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ইসরায়েল স্বীকার করে না।
3. সীমান্ত নির্ধারণ:
১৯৬৭ সালের সীমান্তকে (Green Line) ভিত্তি করে দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রস্তাব
থাকলেও এটি বাস্তবায়িত হয়নি।
4. গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের অবস্থা:
গাজা উপত্যকা হামাসের নিয়ন্ত্রণে এবং এটি ইসরায়েলি অবরোধের কারণে অর্থনৈতিক
ও মানবিক সংকটে ভুগছে। পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি সামরিক দখল ও বসতি স্থাপন চলমান।
মুখ্য সংঘাতগুলো
1. প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (১৯৮৭ এবং ২০০০):
ফিলিস্তিনিদের গণ-আন্দোলন, যা ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।
2. গাজা যুদ্ধ:
-২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং সাম্প্রতিক ২০২১ সালের সংঘাত।
-ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষে অসংখ্য বেসামরিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন।
3. অবরোধ এবং মানবিক সংকট:
গাজা উপত্যকা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে, যার ফলে খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, এবং বাণিজ্যের
অভাব প্রকট।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
1. জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়:
-জাতিসংঘ এবং অনেক দেশ ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে।
-তবে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শান্তি প্রক্রিয়াকে জটিল
করেছে।
2. আরব দেশগুলোর ভূমিকা:
আরব দেশগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে
কিছু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।
সমাধানের সম্ভাবনা
1. দুই রাষ্ট্র সমাধান:
একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র এবং একটি নিরাপদ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব।
2. এক রাষ্ট্র সমাধান:
যেখানে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিরা একত্রে বসবাস করবে। তবে এটি সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, এবং রাজনৈতিকভাবে জটিল।
3. চ্যালেঞ্জ:
-ইসরায়েলের বসতি স্থাপন ও সামরিক দখল।
-ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বিভাজন (ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে)।
-উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা ইস্যু।
গাজা-ইসরায়েল সংঘাতের বিবরণ (অক্টোবর ২০২৩ - সেপ্টেম্বর ২০২৪)
**শুরু এবং প্রথম আঘাত (অক্টোবর ২০২৩):**
”৭ অক্টোবর, ২০২৩:” হামাস ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা
চালায়, যাকে "আল আকসা ফ্লাড" বলা হয়। হামাস বাহিনী ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চল
আক্রমণ করে এবং কিবুতজ, সামরিক ঘাঁটি, ও একটি সঙ্গীত উৎসবে হামলা চালায়। এতে প্রায়
১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২০০+ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
-ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া:** এই হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল গাজার ওপর বড় আকারের বিমান হামলা শুরু করে এবং পুরো গাজা অবরোধ করে খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়*পরবর্তী সংঘাত এবং অগ্রগতি (অক্টোবর ২০২৩ - জানুয়ারি ২০২৪):
- অক্টোবর-নভেম্বর:
- ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলে
বড় আকারের স্থল অভিযান শুরু করে।
- গাজার প্রধান হাসপাতালগুলো, বিশেষ
করে আল-শিফা হাসপাতাল, অবরুদ্ধ অবস্থায় মানবিক সংকটে পড়ে।
- নভেম্বরে ইসরায়েলের আক্রমণে গাজায় নিহতের সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। নিহতদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিলেন।
- সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়,
যেখানে বন্দী বিনিময় ও কিছু ত্রাণসামগ্রী সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়।
- ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পর আবারও দক্ষিণ গাজায় হামলা চালায় এবং খান ইউনিস শহরে প্রবেশ করে।
- জানুয়ারি-এপ্রিল ২০২৪:
- গাজায় মানবিক সংকট তীব্র আকার ধারণ
করে। খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহের অভাবে লক্ষাধিক মানুষ শরণার্থী হন।
- ইসরায়েলের অভিযানে হামাসের বেশ কয়েকটি
টানেল ধ্বংস হয়।
- ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে
সংঘাত বৃদ্ধি পায়।
মে-সেপ্টেম্বর ২০২৪:
- ইসরায়েলের দক্ষিণ গাজায় হামলা চালিয়ে
হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যা করে।
- এই সময়ে আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও
ইসরায়েল ও হামাস কোনো স্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
- জাতিসংঘ একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির
প্রস্তাব পাস করে, যা সংঘাত কমাতে আংশিক ভূমিকা রাখে।
মানবিক প্রভাব:
- সংঘাত চলাকালে গাজায় ৪০,০০০+ মানুষ নিহত এবং অসংখ্য আহত হন।
- গাজার অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এবং শহরটি মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে
পরিণত হয়।
- জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও
সংঘাত বন্ধে সফল হয়নি।
- আঞ্চলিক শক্তি ইরান, হিজবুল্লাহ, এবং মিশর নিজেদের স্বার্থে সংঘাতে বিভিন্নভাবে
জড়িত ছিল
এই সংঘাত গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যে শুধু সামরিক উত্তেজনাই নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের
কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ অব্যাহত থাকলেও স্থায়ী শান্তি
অর্জন এখনো কঠিন।
উপসংহার
ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি স্পর্শকাতর বিষয়,
যা শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, বরং বৈশ্বিক প্রভাব ফেলে। একটি স্থায়ী ও ন্যায্য সমাধান
অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা, এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস
ও সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Very Important Information..
ReplyDelete